হযরত আলী (রাঃ)-এর শাহাদাত বরণ

হযরত আলী (রাঃ)-এর শাহাদাত বরণ

হযরত আলী (রাঃ)-এর শাহাদাত বরণ

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রতি আস্থা এবং মহান আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে বিশ্বনবী (সাঃ)-এর নবুয়াত প্রাপ্তির পরপরই পুরুষদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন হযরত আলী (রাঃ) । কাবা চত্বরে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর চাচা আবু তালিব ও চাচি ফাতেমা বিনতে আসাদের ঘরে হযরত আলী (রাঃ) ৬০১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন । মাত্র নয় বছর বয়সে হযরত আলী (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় সর্বদা তার সঙ্গী, বন্ধু, দেহরক্ষী, পরামর্শদাতা, সেনাপতি সহ নানা ভূমিকায় অনন্য অবদান রেখেছেন ।

আত্মীয়তার দিক থেকে হযরত আলী (রাঃ) ছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর চাচাতো ভাই । মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রিয় কন্যা এবং ইসলামের ইতিহাসে অনুকরণীয় নারী মা ফাতেমা (রাঃ)-এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণে হযরত আলী (রাঃ) মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জামাতায় পরিণত হন । মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সঙ্গে তাকে ইসলামের জন্য জীবনের সবকিছু ব্যয় এবং জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে ঈমান ও আমলের এক অনন্য নজির স্থাপন করেন হযরত আলী (রাঃ) ।

তাই তিনি ছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাহাবী ও প্রিয়জনদের মধ্যে সর্বাধিক খেতাবপ্রাপ্ত । মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন । তার উত্তরসূরি হিসেবে হযরত আলী (রাঃ)-এর সব ধরনের প্রতিভা, প্রজ্ঞা, শারীরিক ও মানসিক শক্তি, সামরিক জ্ঞান, প্রশাসনিক দক্ষতা থাকা সত্বেও তার বদলে ইসলামের প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন হযরত আবু বকর (রাঃ) ।

পরবর্তীতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন যথাক্রমে হযরত ওমর (রাঃ) ও হযরত ওসমান (রাঃ)।হযরত আলী (রাঃ) এসব সিদ্ধান্ত শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করেন । তবে দুঃখজনক ভাবে অপমৃত্যুর শিকার হন হযরত ওমর (রাঃ) এবং হযরত ওসমান (রাঃ) । এসব অপমৃত্যু সহ নানা কারণে মুসলমান, আরব বিশ্ব ও তৎকালীন ক্ষমতার বলয় বিভিন্ন গোত্র, দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে । ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রাঃ)-কে ৮২ বছর বয়সে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে ১৭ জুন শুক্রবার বিকালে আসর নামাজের পর পবিত্র কোরআন মাজীদ পাঠরত অবস্থায় একদল বিপথগামী মিশরীয় আরব তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে ।

এরপর মদিনার মসজিদে অনুষ্ঠিত মুসলমানদের এক সমাবেশে হযরত আলী (রাঃ)-কে চতুর্থ ও মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে নির্বাচন করা হয় । কিন্তু বিপথগামী আরবরা তা মানতে না পেরে হযরত আলী (রাঃ)-কে হত্যার পরিকল্পনা করে । এর মধ্যে ক্ষমতা গ্রহণের এক বছরের মাথায় সিরিয়া সীমান্তে অবস্থিত ইউফ্রেটিস নদীর তীরে হযরত আলী (রাঃ) এবং তার বিরোধিতাকারী মুয়াবিয়া-১ এর বাহিনীর মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয় । সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর সিদ্ধান্ত হয় যে, আলোচনা ও সালিশের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা হবে । ওই যুদ্ধে অংশ নেওয়া একদল আরব এমন সিদ্ধান্ত মানতে না পেরে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে পরবর্তীকালে যাদের “ত্যাগকারী” খারেজী হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয় ।

হযরত আলী (রাঃ)-এর রাজত্ব কালে খারেজীরা কট্টর পন্থা অবলম্বন করে এবং তাদের মতের সঙ্গে অমত পোষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় । একপর্যায়ে তারা সীমা অতিক্রম করে এবং বিভিন্ন মতাবলম্বীদের নাজেহাল করতে থাকে এবং সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয় । হযরত আলী (রাঃ) তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন এবং ৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে সংঘটিত “নাহরাওয়ান” যুদ্ধে তাদের নেতা ইবনে ওহাব সহ অসংখ্য খারাজিকে হত্যা করেন । তবে অবশিষ্ট খারাজী ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে এবং হযরত আলী (রাঃ)-সহ আরো দুজন আরব নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করে ।

এজন্য তিন খারাজীকে পৃথকভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয় । তাদেরই একজন আব্দুর রহমান ইবনে মুলযান বর্তমানে ইরাকের কুফা নগরী হিজরী ৪০ সনের ১৯ রমজান (২৬ জানুয়ারি ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ) বিষ মাখানো তরবারি দিয়ে হযরত আলী (রাঃ)-কে সকালে ফজরের নামাজ আদায় রত অবস্থায় আঘাত করে । তীব্র যন্ত্রণা ভোগের পর মূলত বিষক্রিয়ায় দুদিন পর হযরত আলী (রাঃ) শাহাদাত বরণ করেন ।

একদল গবেষকের মতে হযরত আলী (রাঃ) আশঙ্কা করেন যে তার মৃত্যুর পর শত্রুরা তার মৃতদেহ কবরকে অপমান করতে পারে । তাই নিকট আত্মীয় নজনদের প্রতি তাঁর নির্দেশ ছিল মৃত্যুর পর যেন গোপনে তার সৎকার হয়, যা অনুসরণ বা পালন করা হয় । ফলে দীর্ঘদিন তার কবরের সঠিক অবস্থান অজানা ছিল, পরবর্তীতে ইরাকের নাজাফ শহরে তার কবর রয়েছে বলে দাবি করা হয় । বর্তমানে সেখানে তার মাজার রয়েছে বলে অনেক মানুষ বিশ্বাস করে, যা ঘিরে নির্মিত হয়েছে সোনালী গম্বুজ বিশিষ্ট হযরত আলী মসজিদ ।

অপরদিকে বর্তমান আফগানিস্তানের উত্তর বালাখ রাজ্যের মাজার-ই-শরীফ নামক স্থানে আকর্ষণীয় নীল মসজিদের পাশে হযরত আলী (রাঃ)-কে গোপনে দাফন করা হয়েছে বলে দাবি করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে আরও একটি মাজার। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url